নাগরিক অধিকার

সাত ছেলে-মেয়ে থাকার পরও আশ্রয়হীন মমতাময়ী মা গোলেছা বেগম

“আমার সন্তানেরা যেন সারা জীবন দুধে-ভাতে থাকে” -প্রবাদের মতো এ কথাটি যেন প্রতিটি মায়ের হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে। সন্তানদের সুখের জন্য নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়া সেই মায়েদের একজন গোলেছা বেগম (৭০)। বয়সের শেষ প্রান্তে এসেও যেখানে ভালোবাসার আশ্রয় মিলবে বলে ভেবেছিলেন, সেখানে আজ তিনি আশ্রয়হীন, অবহেলিত।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভূল্লী থানার আওতাধীন ১৮ নম্বর শুখান পুখরী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে দেখা মেলে চার ছেলে ও তিন মেয়ের জননী এই মমতাময়ী মায়ের। জীবনের প্রতিটি দিন কষ্টকে সঙ্গী করে সন্তানদের বড় করেছেন তিনি। স্বামী অছিম পরামানিকের মৃত্যুর পর এক হাতে সংসার সামলানো, অন্য হাতে সন্তানদের মানুষ করা -সবকিছুই করেছেন বুক ভরা ভালোবাসা আর ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু আজ সেই সন্তানদের কাছেই যেন তিনি অচেনা, অবাঞ্ছিত।

চোখের কোণে পানি আটকে রেখে হৃদয়ের কথা শোনান গোলেছা বেগম। বলেন, “অনেক কষ্ট করেছি, খেয়ে না খেয়ে তাদের মানুষ করেছি। ওরা যেন ভালো থাকে, সেজন্য নিজের সুখ-দুঃখ সব ভুলে থেকেছি। শুরুতে সবাই ভালোবাসতো, দেখাশোনা করতো। কিন্তু বয়স বাড়ার পর বুঝলাম -বৃদ্ধি আর বোঝার মধ্যে কেবল একটি শব্দের পার্থক্য!” কথাগুলো বলতে গিয়ে গলার স্বর কেঁপে উঠে।

তিনি আরও বলেন, “অভাবের সংসারে জায়গা-জমি করতে পারিনি। এ জন্য ছেলেরা প্রায়ই কথা শোনাতো। প্রত্যেকে আলাদা ঘর করেছে, সুখে সংসার করছে, কিন্তু আমি যেন তাদের জন্য বাড়তি বোঝা। একজনের ঘরে যাই, বলে অন্যজনের কাছে যেতে। মেয়েদের বাড়িতে কয়েকদিন থেকেছি, কিন্তু তাদেরও অভাবের সংসার- সেখানে থাকাও সম্ভব হয়নি। শেষে বললাম, আলাদা থাকবো, নিজের রান্না নিজে করবো, শুধু একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই দাও- কিন্তু তাতেও মন গলেনি কারো।”

শেষ আশ্রয় হিসেবে ছোট ভাইয়ের কাছে সামান্য জায়গার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। ভাই জায়গা দিতে রাজি হলেও ঘর তুলতে সাহায্য করতে পারেননি। গোলেছা বেগম বলেন, “বয়সভাতার টাকাটা বাঁচিয়ে কয়েকটি টিন কিনে কোনোমতে একটা ঘর তুলেছি। কিন্তু সেই ঘরও কতদিন টিকবে জানি না।”

ঘরটি দেখতে গেলে দেখা যায়, ভাঙা টিনের চাল, চারপাশে ফাঁকফোকর, মেঝেতে মাটি সমান হয়নি। সামনের বর্ষাকাল এলেই ঘরের চারপাশ দিয়ে পানি ঢুকে ভেতরে জলাবদ্ধতা তৈরি হবে- যেখানে থাকা দূরের কথা, পা ফেলা মুশকিল হয়ে পড়বে।

কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, “জানিনা কতদিন এমন কাটাতে হবে। সরকার যদি একটু সাহায্য করে, একটা টেকসই ঘর দেয়, তাহলে অন্তত মাথা গোঁজার জায়গা হবে। বয়স হয়েছে, কাজও করতে পারি না। বেঁচে থাকতে চাই শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে।”