মৃত মুক্তিযোদ্ধা বাবার ঋণ পরিশোধে কিডনি বিক্রি করতে চান ছেলে
বাবার ব্যাংক ঋণ পরিশোধে নিজের একটি কিডনি স্বেচ্ছায় বিক্রি করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের দিনমজুর ছেলে। জেলার গৌরনদী উপজেলার সরিকল গ্রামের বাসিন্দা মো. নাসির তার নিজের ফেসবুক আইডি থেকে এই পোস্টটি করেছেন।
ঘটনার বিস্তারিত জানতে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র ছেলে নাসিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার দিনমজুর বাবা মো. নুরুল ইসলাম ছিলেন রণাঙ্গন কাঁপানো সরকারি ভাতাভোগী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার গেজেট নাম্বার-৩৪৯৩। গৌরনদী সোনালি ব্যাংক থেকে বাবা মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা উত্তোলন করতেন। জীবদ্দশায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে অনেক পদকও পেয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আমার বাবা মৃত্যুর আগে সোনালি ব্যাংক গৌরনদী শাখা থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ উত্তোলন করেছিলেন। এখনও ব্যাংক আমার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা বাবার কাছে ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে। ওই ঋণের জামিনদার ছিলাম আমি। সে হিসেবে অতিসম্প্রতি ব্যাংক থেকে আমার নামে নোটিশ এসেছে। সময়মতো টাকা দিতে না পারলে আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।
নাসির বলেন, বাবার মৃত্যুর পর বিগত তিনবছর পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে তার মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বন্ধ রয়েছে। এনিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন অফিসে দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে আমি এখন পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেছি। বর্তমানে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মানববেতর জীবনযাপন করছি। আমার কোন সম্পদ নেই, যা বিক্রি করে মৃত মুক্তিযোদ্ধা বাবার ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করবো। তাই উপায়অন্তুর না পেয়ে স্বেচ্ছায় আমার একটি কিডনি বিক্রির করার জন্য ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছি।
নাসির আরও বলেন, আমার বাবার গেজেটে তার বাবার অর্থাৎ আমার দাদার নাম আমজেদ আলী হাওলাদারের পরিবর্তে ভুলবশত মৃত মোসলেম উদ্দিন মুন্সী লেখা হয়েছে। ২০১৮ সালে ভুল সংশোধনের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আমার বাবা আবেদন করেন। তার জীবদ্দশায় ভুল সংশোধন করে যেতে পারেননি। এরইমধ্যে ২০২০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করার পর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।
নাসির বলেন, বাবার মৃত্যুর পর গৌরনদী উপজেলা সমাজসেবা অফিসে এমআইএস সংশোধন করতে গিয়ে দেখি রহস্যজনকভাবে আমার বাবার ছবির জায়গায় অন্য একজনের ছবি। এতে আমার সন্দেহ হয়। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ছবির ওই ব্যক্তি মুলাদী উপজেলার মধ্য গাছুয়া গ্রামের বাসিন্দা। সে গৌরনদীর সরিকল নিজাম উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক। তার নাম নুরুল ইসলাম এবং তার বাবার নাম মৃত মোসলেম উদ্দিন। এরপর এমআইএস ফরম সংশোধনের জন্য ২০২১ সালে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে আমি লিখিত আবেদন করি। আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি নিয়ে শুনানীর জন্য আমাকে এবং মুলাদীর নুরুল ইসলামকে তার অফিস কক্ষে হাজির হতে বলেন। পরবর্তীতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানি করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস। ওই শুনানি মুলাদীর নুরুল ইসলাম ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হয়। একপর্যায়ে সে (মুলাদীর নুরুল ইসলাম) ইউএনও’র কাছে লিখিত মুচলেকা দিয়ে রক্ষা পায়। পরবর্তীতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কিন্তু মুলাদীর ওই নুরুল ইসলাম প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে স্থানীয় কতিপয় সুবিধাভোগী মুক্তিযোদ্ধার যোগসাজশে ফের পূনঃতদন্তের জন্য আবেদন করেন। সম্প্রতি উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবু আবদুল্লাহ খান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করেছেন।
প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে নাসির অভিযোগ করে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক নুরুল ইসলামের বাড়ি মুলাদী উপজেলায়। নিয়ম অনুযায়ী তার গেজেট হবে মুলাদীতে। কিন্তু ওই নুরুল ইসলাম মুলাদীতে গেজেট না করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আমার পিতার নামের সাথে তার নামের মিল থাকায় বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আমার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা বাবার গেজেট দিয়ে সে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে আসছেন।
সরিকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফারুক হোসেন মোল্লা বলেন, নাসিরের পিতা নুরুল ইসলাম একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দীর্ঘদিন থেকে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বন্ধ থাকায় অসহায় ওই পরিবারটি চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছেন।
ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, কখনো শুনিনি নিজাম উদ্দিন কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক মুলাদীর বাসিন্দা নুরুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখন তিনি কীভাবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করছেন তা জানা নেই।
তবে জাল-জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করে অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক ও মুলাদী উপজেলার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম নিজেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেন। এমনকি ৩৪৯৩ গেজেট নম্বরটি তার বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবু আবদুল্লাহ খান বলেন, উভয়পক্ষের শুনানি শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। নাসিরকে যাতে ব্যাংক থেকে চাপ প্রয়োগ করা না হয় সেজন্য ম্যানেজারের সাথে কথা হয়েছে।