নাগরিক অধিকার

তিস্তা নিয়ে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী

তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে যাদের প্রস্তাব বেশি লাভজনক হবে, সেটাই বাংলাদেশ গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।

তবে তিনি এও বলেছেন, “ভারত যদি আমাদের তিস্তা প্রজেক্টটা করে দেয়, তাহলে আমাদের সব সমস্যারই তো সমাধান হয়ে গেল। তো সেটাই আমার জন্য সহজ হল না?”

ভারত সফরের অভিজ্ঞতা জানাতে মঙ্গলবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে অন্যান্য প্রসঙ্গের পাশাপাশি তিস্তার বিষয়টি বার বার ঘুরে ফিরে আসে সাংবাদিকদের প্রশ্নে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরে দুই দেশের আলোচনার টেবিলে অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মধ্যে তিস্তার প্রসঙ্গও ছিল। সেখানেই দিল্লির পক্ষ থেকে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখানো হয়।

শনিবার শেখ হাসিনার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, তার সরকার ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কারিগরি পর্যায়ের আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতের একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।

এমন এক সময় ভারত এই আগ্রহ দেখাল, যখন তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের অর্থায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে, জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।

দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ ধরে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, “গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নবায়ন ও বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও পানি সংরক্ষণের প্রকল্পে ভারতের সহায়তার ব্যাপারে আমরা আলোচনা করেছি। তবে এর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তি না হওয়া তিস্তার পানি ভাগাভাগির কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের যে তিস্তা প্রজেক্ট, সেই তিস্তা প্রজেক্টটাই আমরা ভারতের সহযোগিতায় করব, আমরা সেই আশ্বাস পেয়েছি।”

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে দুই দেশের পানি সম্পদ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হয়েছিল।

মনমোহন সিংয়ের সফরেই বহু প্রতীক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় তা আটকে যায়।

নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসার পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশার কথা শোনা গেলেও মমতার মত বদলায়নি।

ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি আটকে থাকার মধ্যে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ শীর্ষক এ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে বেইজিং সফরে এটিসহ আরো কয়েকটি প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সরকারের সহায়তা চেয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর আসে।

তিস্তা প্রকল্পে নদীটির উপকূল ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রীষ্মকালে পানি সংকট দূর করতে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে বলে সেসময় এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল বিবিসি।

এ প্রকল্পে চীনা কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে ঢাকাকে নয়া দিল্লির উদ্বেগ জানানোর মধ্যেই বেইজিং প্রায় ১০০ কোটি ডলারের আনুষ্ঠানিক প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেয়। শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে ওই প্রস্তাব নিয়েই আলোচনা হওয়ার কথা।

এর মধ্যেই গত মাসে ঢাকা সফরে এসে তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে ভারতের আগ্রহের কথা জানান দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা। প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরেও তিস্তা প্রকল্প এবং গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে আলোচনা হয়।

এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদেরকে চীন প্রস্তাব দিয়েছে, ভারতও প্রস্তাব দিয়েছে। অবশ্যই আমি এটা বিবেচনা করব, কোন প্রস্তাবটা করলে পরে আমার দেশের মানুষের, আমার দেশের কল্যাণে আসবে, আমি সেটাই করব।

“লোন কতটুকু নিলাম, কতটুকু আমাকে শোধ দিতে হবে, কতটুকু পাব, এই সবগুলো বিবেচনা করেই তো আমাদের করতে হবে। সেক্ষেত্রে ভারত যখন বলেছে যে তারা করতে চায় এবং তারা টেকনিক্যাল গ্রুপ পাঠাবে, অবশ্যই তারা আসবে। আমরা যৌথভাবে সেটা দেখব।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “চীনও একটা ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে, ভারতও একটা করবে। আমাদের কাছে যেটা সবথেকে বেশি গ্রহণযোগ্য, লাভজনক, আমরা সেটাই করব।

তবে তিস্তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের প্রসঙ্গ ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “ভারত যখন এগিয়ে আসছে, আমরা যদি এটা করি, তাহলে পানি নিয়ে আর প্রতিদিন প্যাঁ প্যাঁ করতে হবে না। আমরা সেই সুবিধাটা পাব। কাজেই আমি তো এখানে কোনো সমস্যা দেখি না।”

এদিকে গঙ্গা-তিস্তার আলোচনা নিয়ে আবারও আপত্তি তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার প্রধানমন্ত্রী মোদীকে লেখা এক চিঠিতে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গকে ‘পাশ কাটিয়ে’ ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন ও তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া ‘অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত’।

গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে মমতার আপত্তি নিয়েও প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “তিস্তায় আমরা প্রজেক্ট নিয়েছি। পুরো নদীটাকে ড্রেজিং করা, পাড় বাঁধানো, পানি সংরক্ষণ, সমস্ত বিষয় সেখানে আলোচনা হয়েছে এবং তিস্তা এবং গঙ্গার জন্য, বিশেষ করে গঙ্গা চুক্তির জন্য, ২০২৬ সালে ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে, এরপর এটা যদি নবায়ন নাও হয়, চুক্তি কিন্তু অব্যাহত থাকবে।

“তবে যেহেতু ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তির মেয়াদটা শেষ হবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, একটা টেকনিক্যাল গ্রুপ করা হবে। যেটা মমতা ব্যনার্জি বলেছেন, উনার ক্ষোভ যে উনার সঙ্গে আলোচনা করেনি, উনি তো ছিলেন না দিল্লিতে। আমি নিজেই তো যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, উনি ছিলেন না। থাকলে নিশ্চয় উনাকে নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। অন্তত আমি করতাম।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার কথা হচ্ছে যে কাউকে বাদ দেওয়া হবে না। এখানে টেকনিক্যাল গ্রুপ আসবে, কথা বলবে, আলোচনা করবে, তারপর সমঝোতা হবে। মমতা ব্যানার্জির যে চিঠি, সেটা তো তিনি লিখেছেন উনার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। এটা তো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এখানে আমার তো কিছু বলার নাই। এটা সম্পূর্ণ ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এভাবে আমার তো নাক গলানোর কোনো দরকার নাই। কিছু বলার দরকার নাই।

“আমার সঙ্গে সকলের সম্পর্ক ভালো। মমতা ব্যানার্জির সম্পর্কও খুব ভালো। আবার প্রাইম মিনিস্টার নরেন্দ্র মোদী, তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো। উনাদের সব দলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। এটুকু বলতে পারি যে ভারতের দল মত নির্বিশেষে প্রত্যেকের সাথে আমার একটা সুসম্পর্ক আছে।”

তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা যে বহু পুরনো, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “সেই তিস্তা প্রজেক্টটা এবার করার জন্য ভারত সহযোগিতা করবে এবং আমাদের যৌথ কমিটি হবে, খালি পানি ভাগাভাগির বিষয়টা না, গোটা তিস্তা নদীটাকেই পুনরুজ্জীবিত করে আমরা উত্তরাঞ্চলে সেচের ব্যবস্থা করা, অধিক ফসল যাতে হয়, ইরিগেশনের ব্যবস্থা, সে ব্যবস্থাটা আমরা করব। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।”