তাবলিগ জামাতের বিভক্তি মতাদর্শের লড়াইয়ে সংঘাত-রক্তপাত থামবে কি?
শাহাদৎ হোসেন:
তাবলিগ জামাত, একটি অরাজনৈতিক ইসলামিক সংগঠন, যারা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের মুসলিম সমাজে ঈমান, আমল এবং আখলাক উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করে আসছে। সংগঠনটি সমাজের সহজ-সরল মানুষদের ইসলামের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে তাদের জীবন পরিচালনার পথ দেখাত বলে ধারণা করা হয় । কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাবলিগ জামাতের ভেতরে দেখা দেওয়া বিভাজন ও সংঘাত এ সংগঠনের ঐক্যের বার্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর টঙ্গীর তুরাগতীরের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে সংঘর্ষে চারজনের প্রাণহানি ঘটে, যা তাবলিগ জামাতের ভেতরকার বিভক্তির ভয়াবহ রূপকে প্রকাশ করে।
২০১৬ সালে তাবলিগ জামাতের ভেতরে বিভক্তির সূচনা ঘটে মাওলানা সাদ কান্ধলভির একটি ফতোয়াকে কেন্দ্র করে। মাওলানা সাদ বলেছিলেন, ‘ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়।’ তিনি মাদরাসা-মসজিদের বেতন বেশ্যাদের উপার্জনের চেয়ে খারাপ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, বেশ্যারা তাদের আগে জান্নাতে যাবে। তার আরও বেশ কিছু বক্তব্য সমালোচনার জন্ম দিলেও মূলত এই বক্তব্যটিই সবার সামনে আনা হয়। যদিও মাওলানা সাদ তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিন্তু তাবলিগের ভাঙন রোধ করতে পারেননি। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে তার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এ বক্তব্যের পরপরই কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা জুবায়ের আহমেদের নেতৃত্বে তাবলিগের একটি অংশ এ মতের বিরোধিতা করেন। এ থেকে সৃষ্টি হয় দুই ধারা -একটি মাওলানা সাদপন্থি এবং অন্যটি মাওলানা জুবায়েরপন্থি।
মাওলানা সাদের ফতোয়ায় তাবলিগ জামাতের ভেতর ও বাইরের অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে বহু আলেম-ওলামা ধর্মীয় শিক্ষার বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, সেখানে এ ধরনের বক্তব্য তাদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি এই বিভাজনকে আরও জটিল করে তোলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিরোধ বেড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়।
গত সরকারের সময়ে তারা ইচ্ছা করলে বিষয়টিকে সমাধান করতে পারত। কিন্তু তারা এটি পরিকল্পিতভাবে জিইয়ে রেখেছে। সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাবলিগের দুই পক্ষকে নিয়ে নিজেই ডিল করতেন। দুই পক্ষই তার কাছে গিয়ে নালিশ করত; কিন্তু কোনো সমাধান হতো না। সে সময়ও একটি ভয়ঙ্কর ঘটনায় দুজন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এখন ১৮ তারিখে যেটা ঘটেছে, সেটা তো আরও ভয়াবহ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে -এসব ঘটনায় বিশ্বের দরবারে ইসলামের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এমনিতেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম জাতি হাজার হাজার ফেরকা, মাজহাব ও তরিকায় বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করছে। তার ওপর তাবলিগের মতো একটি অরাজনৈতিক সংস্থা, যারা মানুষের ঈমান, আমল ও আখলাক নিয়ে কাজ করত, তাদের মধ্যেও এই রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে।
২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে টঙ্গীর তুরাগতীরের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে মাওলানা সাদ ও মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে। উভয় পক্ষ শক্তি প্রদর্শনে মেতে উঠে, যা শেষ পর্যন্ত চারজনের প্রাণহানির কারণ হয়। সংঘর্ষের পরপরই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে টঙ্গী ও আশপাশের এলাকায়। বুধবার সকাল থেকে দুই পক্ষ বিক্ষোভ করতে থাকে। জুবায়েরপন্থিরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে, যা প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সেনা, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যদের মোতায়েন করে। দুপুরের পর ইজতেমা ময়দানের নিয়ন্ত্রণ নেয় প্রশাসন।
এই যে রণমূর্তি, এই যে উগ্রবাদী একটা দৃষ্টিকোণ -এটা দুনিয়ার মানুষের ইসলাম সম্পর্কে একটি ভয়াবহ নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। তাবলিগ জামাত, যারা মানুষকে আমল-আখলাকের বয়ান দিত, নামাজ-রোজার শিক্ষা দিত, সেই তাবলিগের মধ্যে আজ রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
তাবলিগ জামাতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বর্তমান সংঘাতের পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা যায় (১) মাওলানা সাদের ফতোয়া ইসলামী শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণের বিরোধিতা ছিল মূল কারণ। এটি বহু আলেমের জীবিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং তাবলিগের ভেতরে দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। (২) রাজনৈতিক প্রভাব তাবলিগ জামাতের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিশেষ করে, বিগত ক্ষমতাসীন দলগুলোর পক্ষপাতমূলক ভূমিকা এই বিরোধ নিরসনের পরিবর্তে তা বাড়িয়ে তুলেছে। (৩) আন্তর্জাতিক প্রভাব তাবলিগ জামাত একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হওয়ায় বিভিন্ন দেশের আলাদা আলাদা গোষ্ঠী এ বিভাজনকে আরও তীব্র করে তুলেছে। (৪) অন্তর্দ্বন্দ্বের মীমাংসার অভাব দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই বিভাজন সমাধানে কর্তৃপক্ষ ও আলেমসমাজের ব্যর্থতা সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
তাবলিগ জামাতের বর্তমান সংকট শুধু তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার বিষয় নয়; এই সংঘাত গোটা মুসলিম সমাজের জন্য একটি নেতিবাচক বার্তা দেয়। তাবলিগ জামাত, যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলামের শান্তির বার্তা প্রচার করা, তারা নিজেরাই যখন সংঘাতময় রূপ ধারণ করে, তখন ইসলামের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভাজন নতুন কিছু নয়। হাজার বছরের পুরোনো শিয়া-সুন্নি বিরোধ, বিভিন্ন ফেরকা ও মাজহাবের দ্বন্দ্ব মুসলিম সমাজকে বারবার দুর্বল করে তুলেছে। তাবলিগ জামাতের মতো অরাজনৈতিক সংগঠনে যখন এই বিভাজন দেখা দেয়, তখন তা আরও গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাবলিগ জামাতের অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং সংঘাত-সংঘর্ষের এই আচরণ সারা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে এবং ছিছি করেছে। যারা হামলাগুলো করেছে, তাদের শরীর রক্তাক্ত দেখা গেছে, তাদের মাথায়ও টুপি আছে। যারা বাঁশ দিয়ে লাঠি দিয়ে পিটাচ্ছে, তাদেরও মাথায় টুপি আছে, মুখে দাঁড়ি আছে। সংগঠনটির কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মাওলানা সাদ কান্ধলভি ও মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধের মূলে রয়েছে ইসলামী শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নেওয়ার ফতোয়া এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও আধিপত্যের প্রশ্ন। এছাড়াও এই সংঘাতের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন আলেমের উস্কানিমূলক বক্তব্য, যারা তাবলিগের সদস্যদের উস্কানি দিয়ে সংঘাত বাড়িয়ে তুলেছে।
তাবলীগের এই সংঘাত ও রক্তপাতের পর সংগঠনটি কীভাবে সামলে উঠবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তাবলিগ জামাতের বিভক্তির মূল কারণ যাই হোক না কেন, এই বিভক্তির কারণ হিসেবে সামনে এসেছে মতাদর্শগত বিরোধ। অতীতেও দেখা গেছে ইসলাম ধর্মের অনেক বিষয় নিয়ে মতভেদ কিংবা মতবাদগত বিভক্তির কারণে হাজারও গ্রুপ, দল, মাজহাব তৈরি হয়েছে; আজকের তাবলীগ জামাতও সে রকম একটি মতবাদেরই অংশ। মতাদর্শগত কিংবা নেতৃত্ব! মতবিরোধ যে কারণেই হোক না কেন, তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা শীঘ্রই হচ্ছে না সেটা সহজেই অনুমেয়। এই উপলব্ধি তাদের মধ্যে কত দিনে আসবে যে, তাদের এই বিভক্তি যত দ্রুত অবসান হয় ততই তাদের জন্য মঙ্গল।
লেখক: সাংবাদিক