নাগরিক অধিকার

টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত

শেষ ডেলিভারিটি হলো। বল কোথায় গেল, কেউ তাকিয়েই দেখলেন না। বলটি করে মাটিতে বসে রইলেন হার্দিক পান্ডিয়া, তার চোখের কোণে চিকচিক করছে পানি। কেউ কেউ তখন লাফাচ্ছেন, কেউ আবার নানা দিকে ছুটছেন। রোহিত শার্মা তখন মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে। নিজের সঙ্গে কথোপকথন কিংবা স্বপ্ন পূরণের সমীকরণ। আবেগের কত রকম যে প্রকাশ। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতিগুলোই হয়তো এমন!

উল্টো আবেগের স্রোত তখন দক্ষিণ আফ্রিকা দলে। ৫ ওভারে ৩০ রান, উইকেট তখনও বাকি ৬টি। বিশ্বকাপের সঙ্গে এইটুকুই দূরত্ব ছিল তাদের। অনেক অনেক বছরে যন্ত্রণা, অনেক প্রজন্মের দীর্ঘশ্বাস আর একটি ক্রিকেট জাতির অপেক্ষা। সবকিছুর অবসান তখন স্রেফ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু শেষ সময়েই ফিরে এলো সেই দুঃসহ অতীতের থাবা। ‘চোকার’ তকমা পোক্ত হয়ে গেল আরও। এভাবেও হারা যায়!

পরাজয়ের দুয়ার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জয়ের কত ঘটনাই তো ক্রিকেট ইতিহাসে আছে। ভারত হয়তো ছাড়িয়ে গেল সবকিছুকেই। রোমাঞ্চ আর উত্তেজনার ঢেউয়ে ভেসে স্কিল আর স্নায়ুর লড়াইয়ে জিতে টি-টোয়েন্টি নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রোহিত শার্মার দল। বারবাডোজের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাল তারা ৭ রানে।

সেই ২০০৭ সালে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। এত বছর পর তার স্বাদ পেল দ্বিতীয় শিরোপার। দেশের মাঠে ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ আর ইংল্যান্ডে ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের পর একটি আইসিসি ট্রফি জয়ের দীর্ঘ প্রতীক্ষাও শেষ হলো তাদের।

ইতিহাস গড়েই তারা স্মরণীয় করে রাখল এই উপলক্ষ। টি-টোয়েন্টির প্রথম অপরাজিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এই ভারতই।

এই ইতিহাস গড়ার হাতছানি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সামনেও। দুই সংস্করণে সাতবার সেমি-ফাইনালে আটকে পড়ার পর প্রথমবার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল তারা। প্রথম শিরোপার সুবাসও পাচ্ছিল তারা। এইডেন মার্করামের এই দল অন্যরকম, সত্যিই তা মনে হচ্ছিল আবার। কিন্তু আসল সময়টাতেই তারা হারিয়ে গেল অতীতের চোরাবালিতেই।

কেনসিংটন ওভালে শনিবার ২০ ওভারে ভারত তোলে ৭ উইকেটে ১৭৬ রান।

যার ফর্মহীনতা নিয়ে আলোচনা ছিল অনেক, সেই কোহলি রানে ফিরলেন সবচেয়ে বড় ম্যাচেই। আসরে আগের সাত ম্যাচ মিলিয়ে তার রান ছিল ৭৫, ফাইনালেই করলেন ৭৬। সঙ্গে আকসার প্যাটেল, শিভাম দুবের কার্যকর অবদানে ভারত পেল ওই পুঁজি।

রান তাড়ায় শুরুতে হোঁচট খাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবল প্রতাপে ছুটতে থাকল মাঝের সময়টায়। ভারতীয় স্পিনারদের গুঁড়িয়ে বিধ্বংসী ফিফটি করলেন হাইনরিখ ক্লসেন। কিন্তু সপ্তদশ ওভারে তার বিদায় দিয়ে যে পতনের শুরু, প্রোটিয়ারা আর পারল না মাথা তুলে দাঁড়াতে।

কিছুদিন আগে আইপিএলে ফর্মহীনতায় আর মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের নেতৃত্ব মিলিয়ে যিনি ছিলেন ভারতজুড়ে সমালোচনার কেন্দ্রে, সেই হার্দিক পান্ডিয়া ক্লসেনকে ফিরিয়ে ভারতকেও ফেরালেন ম্যাচে। জাসপ্রিত বুমরাহ ও আর্শদিপ সিংয়ের দারুণ দুটি ওভারে আরও শক্ত হলো লাগাম। শেষ ওভারেও কাজটা ঠিকঠাক করলেন পান্ডিয়া। সম্মিলিত পারফরম্যান্সের দারুণ নজির গড়েই শিরোপা জিতল তারা।

ম্যাচের শুরুটা ভারতের ছিল আগ্রাসী। ম্যাচের প্রথম ওভারেই মার্কো ইয়ানসেনকে তিনটি চার মারেন কোহলি। ওভার থেকে আসে ১৫ রান। বিশ্বকাপের ফাইনালে যা সবচেয়ে বেশি রানের প্রথম ওভারের রেকর্ড।

পরের ওভারটি ছিল নাটকীয়। কেশাভ মহারাজের প্রথম দুই বল বাউন্ডারিতে পাঠান রোহিত শার্মা। কিন্তু এই ওভারেই দুই ব্যাটসম্যানকে ড্রেসিং রুমে পাঠান মহারাজ। সুইপ খেলে আউট হন রোহিত ও তিনে নামা রিশাভ পান্ত।

তৃতীয় উইকেট আসতেও দেরি হয়নি। সুরিয়াকুমার ইয়াদাভের ক্যাচ নেওয়ার পর মাটিতে শুয়েই উদযাপন করতে থাকেন হাইনরিখ ক্লসেন, খ্যাপাটে উদযাপনে মেতে ওঠেন বোলার কাগিসো রাবাদা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আগের ছয় ইনিংসে যার একটি সেঞ্চুরি আর চারটি ফিফটি, তাকে ফিরিয়ে এমন উল্লাস তো হবেই!

পরিস্থিতির জবাব দিতে ভারত পাঁচে নামিয়ে দেয় আকসার প্যাটেলকে। প্রথম বলেই বাউন্ডারি আর একটু পরেই ছক্কা মেরে তিনি বুঝিয়ে দেন, কোন দায়িত্ব দিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছে। কোহলি মনোযোগ দেন ইনিংস গভীরে টেনে নেওয়ার কাজে।

নিজের কাজটা দুজনই ঠিকঠাক করায় গড়ে ওঠে জুটি। ৫৪ বলে ৭২ রানের এই জুটি থামে আকসারের কিছুটা আলসেমি আর কুইন্টন ডি ককের ক্ষিপ্রতায়। দারুণ খেলে চার ছক্কায় ৩১ বলে ৪৭ করে রান আউটে ফেরেন আকসার।

মাঝের সময়টায় একটু থমকে পড়েন কোহলি। তবে আরেক প্রান্তে রানের ধারা ছিল প্রবাহমান। আকসার বিদায় নিলেও একই স্রোতে বয়ে যান শিভাম দুবে।

কোহলি ফিফটিতে পা রাখেন ৪৮ বলে, সপ্তদশ ওভারে। এরপর ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। রাবাদার ওভারে মারেন ছক্কা ও চার, ইয়ানসেনের ওভারেও তা-ই। আরেকটি ছক্কার চেষ্টায় তার ইনিংস থামে শেষের আগের ওভারে।

দুবের সঙ্গে তার জুটিতে আসে ৩৩ বলে ৫৭ রান। ১৬ বলে ২৭ করে দুবে আউট হন শেষ ওভারে।

শেষ ৬ ওভারে ৬৮ রান তোলে ভারত।

রান তাড়ার শুরুতে জোড়া ধাক্কায় কিছুটা টালমাটাল হয়ে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। জাসপ্রিত বুমরাহর অসাধারণ এক ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে যান রিজা হেনড্রিকস। পরের ওভারে আর্শদিপের বলে আলগা শটে উইকেট হারান অধিনায়ক মার্করাম।

তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সাহসের বার্তা হয়ে আসেন তরুণ ট্রিস্টান স্টাবস। অভিজ্ঞ কুইন্টন ডি কক সঙ্গ দেন। পাল্টা আক্রমণে বাড়তে থাকে রান ও দলের আশা।

৩৩ বলে ৫৮ রানের জুটি শেষে স্টাবস ফেরেন ৩১ রানে। ডি ককের ইনিংস থামে ৩৯ রানে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস আরও গতিময় হয় ক্লসেনের ব্যাটে।

আকসার প্যাটেলের এক ওভারে ক্লসেনের দুই ছক্কা দুই চারে যখন রান আসে ২২, দক্ষিণ আফ্রিকা তখন জয়ের সুবাস পাচ্ছে তীব্রভাবেই। ক্লসেন আর ডেভিড মিলার তখন ক্রিজে। বাইরে এতগুলি উইকেট। এই ম্যাচ তো কার্যত শেষ!

কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচ তো শেষের আগে শেষ নয়!

১৬ ওভার শেষে হাঁটুর চোট পেয়ে মাঠেই চিকিৎসা নিলেন রিশাভ পান্ত। একটু থমকে থাকল খেলা। ক্লসের মনোযোগেও হয়তো চিড় ধরল। খেলা শুরু হতেই প্রথম ডেলিভারিতে অনেক বাইরের বল তাড়া করে আউট ক্লসেন (২৭ বলে ৫২)।

পরের ওভারে বুমরাহ এসে দুর্দান্ত ডেলিভারিতে মার্কো ইয়ানসেনকে বোল্ড করলেন। ওভারে রান দিলেন স্রেফ দুটি। ম্যাচ একটু একটু করে দূরে সরতে থাকল দক্ষিণ আফ্রিকার। ১৯তম ওভারে আর্শদিপ দিলেন কেবল চার রান।

শেষ ওভারে সমীকরণ দাঁড়াল ১৬ রানের। পান্ডিয়ার প্রথম বলটি উড়িয়ে মারলেন মিলার। চাপের মধ্যে সীমানায় অসাধারণ ক্যাচ নিলেন সুরিয়াকুমার। এরপর ভারতের জয় কেবল আনুষ্ঠানিকতা।

গৌরবময় ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় এসে প্রথমবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেলেন কোহলি। ম্যাচ সেরা হয়ে তিনি এই সংস্করণ থেকে বিদায়ের ঘোষণাও দিলেন হাসিমুখে।

আর রোহিত শার্মা? ভারতের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাক্ষী, কয়েক মাস আগে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালের পরাজিত নায়ক, এবার আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়কত্ব থেকেও সরানো হয়েছে যাকে, তিনিই এখন টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক।

গত এক বছরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে যাওয়া দল, অনেক বছর ধরে একটি আইসিসি ট্রফির তেষ্টায় ছটফট করতে থাকা ভারত, অবশেষে পেল একটি বৈশ্বিক শিরোপার স্বপ্নময় পরশ।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ভারত: ২০ ওভারে ১৭৬/৭ (রোহিত ৯, কোহলি ৭৬, পান্ত ০, সুরিয়াকুমার ৩, আকসার ৪৭, দুবে ২৭, পান্ডিয়া ৫*, জাদেজা ২; ইয়ানসেন ৪-০-৪৯-১, মহারাজ ৩-০-২৩-২, রাবাদা ৪-০-৩৬-১, মার্করাম ২-০-১৬-০, নরকিয়া ৪-০-২৬-২, শামসি ২৩-০-২৬-০)।

দক্ষিণ আফ্রিকা: ২০ ওভারে ১৬৯/৮ (হেনড্রিকস ৪, ডি কক ৩৯, মারক্রাম ৪, স্টাবস ৩১, ক্লসেন ৫২, মিলার ২১, ইয়ানসেন ২, মহারাজ ২*, রাবাদা ৪, নরকিয়া ১*; আর্শদিপ ৪-০-২০-২, বুমরাহ ৪-০-১৮-২, আকসার ৪-০-৪৮-১, কুলদিপ ৪-০-৪৫-০, হার্দিক ৩-০-২০-৩, জাদেজা ১-০-১২-০)।

ফল: ভারত ৭ রানে জয়ী।

ম্যান অব দা ম্যাচ: ভিরাট কোহলি।

ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট: জাসপ্রিত বুমরাহ।